যুদ্ধ: লুইজি পিরানদেল্লো

Published in Kali o Kalam.

 

       রাত্রির ট্রেনে যেসব যাত্রী রোম ত্যাগ করছিলো, ভোরে তাদেরকে ফাব্রিয়ানোতে থামতেই হলো, ছোট সেকেলে সুলমোনার মূল লাইনের সাথে জোড়া লোকাল ধরে যাতে তারা তাদের যাত্রা অবিচ্ছিন্ন রাখতে পারে।

ভোরে, ধোঁয়াভরা বদ্ধ বগিতে, যাতে কি-না পাঁচজন মানুষ রাত্রিযাপন করেছে, শোকের পোশাক পরা মোটাসোটা এক মহিলাকে তোলা হলো, প্রায় আকারবিহীন এক পোটলার মতো। তার পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে এবং গোঙাতে গোঙাতে এল তার স্বামী, ছোট্ট একজন মানুষ, রোগা-দুবলা, মৃতের মতো সাদা তার মুখ, চোখজোড়া ছোট, উজ্জ্বল এবং লজ্জা ও অস্বস্তিভরা।

অবশেষে সিটে বসে, তার স্ত্রীকে যারা সাহায্য করে জায়গা করে দিয়েছিল, তাদের সে ধন্যবাদ দিল; তারপর কোটের কলার টেনে নামানোয় ব্যস্ত স্ত্রীর দিকে ঘুরে খুব তমিজের সঙ্গে জানতে চাইল, “তুমি ঠিক আছো তো?”

স্ত্রীটি জবার দেওয়ার বদলে মুখ ঢাকতে কলার টেনে চোখ পর্যন্ত তুলে ফেলল।

“দুনিয়াটা বড় খারাপ জায়গা,” দুঃখী হাসি হেসে স্বামীটি বিড়বিড় করল।

তার মনে হলো, সহযাত্রীদের কাছে ব্যাখ্যা করা দরকার যে মহিলার জন্য তাদের মায়া হওয়া উচিত, কারণ যুদ্ধ তার একমাত্র পুত্রকে সরিয়ে নিচ্ছিল তার কাছ থেকে। বিশ বছর বয়সের এক ছেলে, যার জন্য দুজনেই গোটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে। এমনকি সুলমোনা থেকে সংসার গুটিয়ে ছেলের পেছন পেছন তারা রোম পর্যন্ত গিয়েছিল। ছেলে সেখানে ছাত্র। এখন তাকে যুদ্ধের জন্য নাম লেখাতে দিতে` হয়েছে; অবশ্য এই নিশ্চয়তায় যে অন্তত ছমাস তাকে ফ্রন্টে পাঠানো হবে না। কিন্তু এখন, হঠাৎ করেই, টেলিগ্রাম এসেছে যে তিন দিনের মধ্যে সে চলে যাচ্ছে। তারা গিয়ে যেন তাকে বিদায় দেয়।

বড় কোটটির নিচে মহিলার শরীর মোচড় দিচ্ছিলো। সময় সময় জানোয়ারের মতো গোঙাচ্ছিল। নিশ্চিত যে এতসব ব্যাখ্যায় এইসব মানুষ, যাদের অবস্থা খুব সম্ভব তারই মতো, তাদের মনে সহানুভূতির ছায়ারও জন্ম হবে না। একজন যে খুব মন দিয়ে শুনছিল বলল, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ কারণ আপনার ছেলে এখন ফ্রন্টে যাচ্ছে। আমারটাকে তো যুদ্ধের প্রথম দিনই পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যেই দুবার আহত অবস্থায় সে ফেরত এসেছে এবং তাকে আবারও ফ্রন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“আর আমি? ফ্রন্টে আমার দ্ইু ছেলে, তিন ভাতিজা,” বলল আরেক যাত্রী।

“তা হতে পারে, কিন্তু আমাদের বেলায়, এ-আমাদের একটিই ছেলে,” বলার চেষ্টা করল স্বামীটি।

“তাতে হলোটা কী? একমাত্র ছেলেকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে দিয়ে আপনারা নষ্ট করতে পারেন, কিন্তু আপনাদের যদি আর ছেলেমেয়ে থাকত, তাহলে একজনকে অন্যদের চাইতে কিছুতেই বেশি ভালোবাসতে পারতেন না। বাবার আদর তো আর রুটি নয় যে ভেঙে টুকরো করা যায় আর সমান ভাগ করে ছেলেমেয়েদের দেওয়া যায়। একজন বাবা কোনো পক্ষপাত না করে প্রতিটি সন্তানকে তার ভালোবাসার সবটুকুই দেয়, সে একজনই হোক আর দশজনই হোক, আর দুছেলের জন্য আমি যে-যন্ত্রণা পাচ্ছি, তা একেকজনের জন্য অর্ধেক যন্ত্রণা নয়, বরং দ্বিগুণ।“

“তা ঠিক, তা ঠিক…,” নিশ্বাস ফেলল লজ্জিত স্বামীটি, “কিন্তু (অবশ্য আমরা সবাই দোয়া করি কোনোদিনই আপনার যেন এমন না হয়) ধরুন ফ্রন্টে এক বাবার দুই ছেলে, আর একজনকে সে হারাল, তাহলেও তাকে    সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আরেকজনতো আছে…অন্যদিকে…”

“হ্যাঁ,” অপরজন বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, “সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এক ছেলে থাকে বটে, কিন্তু সেই ছেলের জন্য আবার বেঁচেও থাকতে হয়। যে বাপের এক ছেলে, সেই ছেলে মারা গেলে, সে নিজে মরে গিয়ে যন্ত্রণা ঘোচাতে পারে। দুটির মধ্যে কোনটি বেশি খারাপ? আমার অবস্থা যে আপনার চাইতে খারাপ, সেটি দেখতে পাচ্ছেন না?”

“বাজে কথা,” মাঝখান থেকে বলল আরেক যাত্রী। মোটা, লালমুখো এক লোক, হালকা ছেয়ে চোখ তার রক্তবর্ণ। হাঁপাচ্ছিল সে। তার ঠেলে বের হওয়া চোখ ফুঁড়ে যেন বেরোচ্ছিল অনিয়ন্ত্রিত জীবনীশক্তিসম্পন্ন অন্তর্লীন এক হিংস্রতা, যা তার দুর্বল শরীর ধারণ করতে পারছিল না।

“বাজে কথা,” সামনের দাঁত দুটি যে নেই, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তা লুকোনোর চেষ্টা করতে করতে সে আবার বলল, “বাজে কথা। আমরা কি নিজেদের সুবিধার জন্য আমাদের সন্তানদের জন্ম দেই?”

অন্য যাত্রীরা শঙ্কিতভাবে তার দিকে ফিরল। যার ছেলে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই ফ্রন্টে সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছেন, আমাদের সন্তানতো আমাদের না, দেশের…”

“ধ্যাত,” জবাব দিল মোটা যাত্রী, “আমরা যখন আমাদের সন্তানদের জন্ম দেই, তখন কি আমরা দেশের কথা ভাবি? আমাদের ছেলেরা জন্মায় কারণ… আসল কারণ, জন্মাতে তাদের হবেই। আর তারা যখন জীবনের পথে প্রথম পা ফেলে, তখন সাথে সাথে আমাদের জীবনটাও তারা নিয়ে নেয়। এটিই সত্য। আমরা ওদের, কিন্তু ওরা কখনোই আমাদের নয়। আর ওরা যখন বিশ বছর বয়সে পৌঁছায়, তখন ওই বয়সে আমরা যে-রকম ছিলাম, ওরাও সে-রকমই হয়। আমাদেরও বাবা ছিল, মা ছিল, কিন্তু তার সাথে আরো এত কিছু ছিল… মেয়ে, সিগারেট, মোহ, নতুন বন্ধন… আর অবশ্যই দেশ, যার ডাকের জবাব আমরা দিতামই, যখন আমাদের বয়স বিশ বছর ছিল, বাবা-মা না বললেও। এখন আমাদের বয়সে, দেশের জন্য আমাদের ভালোবাসা প্রবল অবশ্যই, কিন্তু তার চাইতেও প্রবল আমাদের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। আমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে যদি পারত তো খুশিমনে ফ্রন্টে গিয়ে ছেলের জায়গা নিয়ে নিত না?”

চারদিক নিঃশব্দ, সবাই একমত হয়ে মাথা নাড়ছে।

“তাহলে কেন,” মোটা লোকটি বলে চলল, “তারা যখন বিশ বছর বয়সে, তাদের অনুভূতির কথা আমরা কেন চিন্তা করব না? ওদের বয়সে দেশের জন্য ভালোবাসা (অবশ্য আমি ভালো ছেলেদের কথা বলছি) আমাদের জন্য ভালোবাসার চাইতে প্রবল হবে, এটিই কি স্বাভাবিক নয়? সেটিই কি স্বাভাবিক নয়, কারণ ওরাতো আসলে আমাদেরকে ভাবে বুড়ো, যারা আর নড়াচড়া করতে পারে না বলে ঘরেই থাকে। দেশ যদি থাকে, দেশ যদি একটি স্বাভাবিক প্রয়োজন হয়ে থাকে, রুটির মতো, যা অনাহারে মরতে না চাইলে খেতেই হবে, তাহলে কাউকে না কাউকে যেতেই হবে দেশকে রক্ষা করতে। যায় আমাদের ছেলেরা, তাদের বয়স যখন বিশ, আর চোখের জল তারা চায় না, কেননা তারা যদি মারাই যায়, তো তারা মরে উত্তেজিত এবং সুখী অবস্থায় (অবশ্য আমি ভালো ছেলেদের কথাই বলছি)। এখন কেউ যদি তরুণ এবং সুখী অবস্থায় মারা যায়, জীবনের কুৎসিত দিকগুলো না জেনেই জীবনের বিরক্তি, ক্ষুদ্রতা, স্বপ্নভঙ্গের তিক্ততা… এর বাইরে তার জন্য আমরা আর কী চাইতে পারি? সবারই উচিত কান্নাকাটি বন্ধ করা; সবার উচিত হাসা, আমার মতো… অথবা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, আমার মতো, কারণ মারা যাওয়ার আগে ছেলে আমার খবর পাঠিয়েছিল যে সে মরছে তৃপ্তি নিয়ে তার চাওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মৃত্যু তার ঘটছে বলে। সেজন্যই, দেখতে পাচ্ছেন, আমি এমনকি শোকের পোশাকও পরিনি…”

সে তার হালকা হরিণরঙা কোটটি একটু নাড়ল দেখানোর জন্য। তার ফোকলা দাঁতের ওপর দগদগে লাল ঠোঁট কাঁপছিল, চোখ ছিল তার টলটলে এবং স্থির এবং একটু পরই সে এমন এক হাসি দিয়ে শেষ করল, যা কি-না ফোঁপানির মতই শোনাল।

“তাতো বটেই… তাতো বটেই…” অন্যরা একমত হলো।

এককোণে পোটলার মতো কোটের তলায় বসে থাকা মহিলা, যে গত তিন মাস ধরে স্বামী ও বন্ধু-বান্ধবদের কথায় এমন কিছু একটা খুঁজেছে, যা তার গভীর শোকে কিছুটা সান্ত্বনা দেবে, এমন কিছু যা তাকে দেখাবে কিভাবে একজন মা সন্তানকে মৃত্যু নয়, মাত্র জীবনের ঝুঁকির সম্ভাবনার দিকেই পাঠাতে পারে, অসংখ্য কথার মধ্যে সে একটি শব্দও খুঁজে পায়নি… সে ভেবেছিল যে আর কেউই তার অনুভূতিগুলোর ভাগীদার নয়, এই ভেবে তার শোক হয়ে উঠেছিল গভীরতর।

কিন্তু এখন, ওই যাত্রীর কথায় সে আশ্চর্য এবং বিস¥য়াহত হচ্ছিল। হঠাৎ করেই সে বুঝল, অন্যরা যে ভুল করছে বা তাকে বুঝতে পারছে না, ব্যাপারটি তা নয়, বরং সে-ই অন্য বাবা-মা যারা কোনো কান্নাকাটি ছাড়া ছেলেদের বিদায় শুধু নয়, মৃত্যু পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে, তাদের পর্যায়ে উঠতে পারছে না।

সে মাথা উঁচু করল, তার কোনা থেকে খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগল, মোটা লোকটি তার ছেলের, রাজা এবং দেশের জন্য বীরের মতো গ্রহণ করা সুখী এবং আক্ষেপহীন মৃত্যুর খুঁটিনাটি সব বর্ণনা দিচ্ছিল। তার কাছে মনে হলো যা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি এমন এক দুনিয়াতে হোঁচট খেয়ে পড়েছে। তার কাছে এখন পর্যন্ত অপরিচিত এক দুনিয়া। আর সকলে, এই বীর পিতা, যে এত স্থৈর্যের সঙ্গে সন্তানের মৃত্যুর কথা বলেছে, তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে শুনে তার খুব ভালো লাগছিল।

তখন হঠাৎ করে, যেন এতক্ষণ কী বলা হলো তার কিছুই সে শোনেনি, আর সে স্বপ্ন থেকে জাগছে, এমনভাবে বুড়ো লোকটির দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে… আপনার ছেলে সত্যিই মারা গেছে?” সবাই তার দিকে তাকাল। বুড়ো লোকটিও ঘুরে তার বড় বড় ঠেলে বের হওয়া, ভয়ংকর জলো হালকা ছেয়ে চোখজোড়া দিয়ে স্থির ও গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। অল্প সময়ের জন্য সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখে তার কথা সরল না। সে তার দিকে তাকিয়েই রইল, তাকিয়েই রইল, যেন মাত্র তখনই, ওই বোকাটে, বেমানান প্রশ্নে, সে হঠাৎ করেই অবশেষে বুঝতে পেরেছে যে ছেলেটি তার সত্যিই মারা গেছে… চিরকালের জন্য চলে গেছে… চিরকালের জন্য। তার মুখ কুঁকড়ে উঠল, ভয়ংকর রকম বিকৃত হয়ে উঠল, দ্রুত টান দিয়ে সে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করল, আর, সবাইকে চমকে দিয়ে সে যন্ত্রণাকাতর, হৃদয়ভাঙা, নিয়ন্ত্রণহীন কান্নায় ভেঙে পড়ল।